সিলেটে শূন্যতা: একে একে নিভেছে প্রদীপ

  • বিশেষ প্রতিনিধি
  • প্রকাশ: ৩০ এপ্রিল ২০২২, ১১:২২ পূর্বাহ্ণ | আপডেট: ৩ বছর আগে
  • Print

এমন জীবন তুমি করিবে গঠন, মরণে হাসিবে তুমি কাঁদিবে ভুবন। ’ মানুষকে নিয়ে কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের লেখনিটি চিরকাল বাণী হয়ে রইল।

যেসব কীর্তিমানদের মরণে অশ্রুর সঞ্চার ঘটে। কাঁদে কোটি প্রাণ। তাদের মৃত্যু নেই। তারা কেবলই প্রস্থান করেন অনন্তকাল। বেঁচে থাকেন মানুষের অন্তরের অন্ত‍ঃস্থলে। মানুষের ভালোবাসায় নিমজ্জিত হয়ে থাকেন।

 

তবে তাদের শূন্যতা রয়ে যায় পৃথিবীর বুকে অনন্তকাল। সেই শূন্যতায় ভুগছে সিলেট। একে একে নিভে যাচ্ছে সব প্রদীপ। যারা নিজের মেধা, মননশীলতা সমাজ ও রাষ্ট্রের প্রজ্জ্বলিত দ্বীপকে আগলে রেখেছিলেন, একে একে পৃথিবীর মোহ ত্যাগ করে বিদায় নিয়েছেন।

সিলেটে বেড়ে ওঠে সমাজ, রাষ্ট্রের গণ্ডি ছাড়িয়েও যাদের যশ-খ্যাতি, সেসব মানুষের প্রস্থানে যেন অন্ধকারে নিমজ্জিত হচ্ছে সিলেট। জাতীয় সংসদের সাবেক স্পিকার প্রয়াত হুমায়ুন রশীদ চৌধুরী, সাবেক অর্থমন্ত্রী মরহুম শাহ এএমএস কিবরিয়া, বর্ষীয়ান আওয়ামী লীগ নেতা সাবেক পররাষ্ট্রমন্ত্রী মরহুম আবদুস সামাদ আজাদ, সাবেক অর্থমন্ত্রী মরহুম এম সাইফুর রহমান, সাবেক প্রতিমন্ত্রী ও মুক্তিযুদ্ধের সংগঠক মরহুম দেওয়ান ফরিদ গাজী, প্রাদেশিক পরিষদের সদস্য সাত বারের সংসদ সদস্য, সাবেক মন্ত্রী সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত। তারা সবাই ছিলেন সিলেটের মানুষের মধ্যমণি। সিলেটকে তিমিরে রেখে একে একে তারা সবাই চলে গেছেন না ফেরার দেশে।

এবার সর্বশেষ বরেণ্য অর্থনীতিবিদ সাবেক অর্থসন্ত্রী সিলেটের সর্বজন শ্রদ্ধেয় অভিভাবক। এ অঞ্চলের মাটি ও মানুষের অকৃত্রিম বন্ধু আবুল মাল আবদুল মুহিত চলে গেলেন নশ্বর এ পৃথিবী ছেড়ে।

তারা শুধু একেকটি নাম নয়, একেকটি ইতিহাস। বাংলাদেশ তো বটেই, দক্ষিণ এশিয়ার রাজনীতির অন্যতম পুরোধা ব্যক্তিত্ব ছিলেন এরা সবাই। কিন্তু প্রকৃতির অমোঘ নিয়ম থামিয়ে দিয়েছে তাদের পথচলা, শূন্যতায় ভরিয়ে রেখেছে চারপাশ।

শুরুটা হুমায়ুন রশীদ চৌধুরীকে দিয়ে। শেষটা আবুল মাল আবদুল মুহিত। একে একে ঝরে গেছেন বর্ণাঢ্য, বর্ণিল রাজনৈতিক ক্যারিয়ারের সাতজন উজ্জ্বল নক্ষত্র।

হুমায়ুন রশীদ চৌধুরী: কূটনৈতিক ব্যক্তিত্ব ছিলেন তিনি। সিলেটের এ সন্তান ছিলেন পোক্ত রাজনীতিবিদ। সিলেট-১ আসন থেকে সংসদ সদস্য হওয়া হুমায়ুন রশীদ ১৯৯৬ সালে আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে স্পিকারের দায়িত্বে ছিলেন। ২০০১ সালের ১০ জুলাই হৃদযন্ত্রের ক্রিয়া বন্ধ হয়ে মারা যান। তার প্রয়াণের মধ্য দিয়ে শুরু হয় নক্ষত্রের পতন।

শাহ এএমএস কিবরিয়া: হবিগঞ্জে জন্ম নিলেও পুরো সিলেট কথা দেশকে আলোকিত করা কূটনীতি, অর্থনীতি সমানতালে সামলে ছিলেন। ভাষা আন্দোলন ও মুক্তিযুদ্ধেও ছিল তার ভূমিকা। নব্বইয়ের দশকে আনুষ্ঠানিকভাবে রাজনীতিতে আসা কিবরিয়া ১৯৯৬ সালে আওয়ামী লীগ সরকারের অর্থমন্ত্রী নিযুক্ত হন। দেশের অর্থনীতিকে এগিয়ে নিতে তার ভূমিকা ছিল প্রশংসনীয়। ২০০৫ সালের ২৭ জানুয়ারি বর্বরোচিত গ্রেনেড হামলা চালিয়ে হত্যা করা হয় নন্দিত এ নেতাকে।

আবদুস সামাদ আজাদ: বর্ণাঢ্য রাজনৈতিক জীবনের অধিকারী ছিলেন সুনামগঞ্জে জন্ম নেওয়া এ সিংহপুরুষ। বাংলাদেশ পঞ্চম সংসদের বিরোধীদলীয় এ উপনেতা মুজিবনগর সরকারের পররাষ্ট্রমন্ত্রীর দায়িত্বে ছিলেন। হাওরপাড়ের সন্তান সামাদ আজাদ মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে ব্যাপক জনমত গঠনে কাজ করেছিলেন। স্বাধীনতার পর ১৯৭২ সালে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বাধীন মন্ত্রিসভায় কৃষিমন্ত্রী ছিলেন সামাদ আজাদ। বাংলাদেশের প্রথম পররাষ্ট্রমন্ত্রীর কৃতিত্ব আজীবন তাকে মহিমান্বিত করেছে। ৭৯ বছর বয়সে ২০০৫ সালের ২৭ এপ্রিল শেষ নিশ্বাস ত্যাগ করেন।

এম সাইফুর রহমান: অর্থমন্ত্রী হিসেবে বিশ্বে সমীহ আদায় করে নিয়েছিলেন তিনি। মৌলভীবাজারের সন্তান সাইফুর রহমান জাতীয় সংসদে ১২ বার বাজেট পেশের সম্মানের অধিকারী। বায়ান্নর ভাষা আন্দোলনে অসামান্য ভূমিকার জন্য ২০০৫ সালে একুশে পদকে ভূষিত হয়েছিলেন। অর্থনীতির মতো রাজনীতিতেও মেধার স্বাক্ষর রেখেছিলেন সাইফুর। জীবদ্দশায় বিএনপির প্রভাবশালী এ নেতা বাংলাদেশে অর্থমন্ত্রী হিসেবে সবচেয়ে বেশি সময় অধিষ্ঠিত ছিলেন। ২০০৯ সালের ৫ সেপ্টেম্বর মর্মান্তিক সড়ক দুর্ঘটনায় মারা যান অর্থনীতির এ অনন্য প্রতিভা।

দেওয়ান ফরিদ গাজী: মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম সংগঠক হবিগঞ্জের সন্তান দেওয়ান ফরিদ গাজী ছাত্র অবস্থায় রাজনীতিতে পথচলা। ১৯৪২ সালে ‘ভারত ছাড়’ আন্দোলনে যুক্ত হন। ১৯৪৫ সালে আসামে ‘বাঙাল খেদাও’ অভিযানের প্রতিবাদকারী ভাষা আন্দোলনের সূচনালগ্নে সংগঠকের ভূমিকা পালন করেন তিনি। ছয় দফা কর্মসূচিতে যোগদানের দায়ে ১৯৬৭ সালে পাক পুলিশের হাতে গ্রেফতার হয়ে ১১ মাস কারাভোগ করেন। সত্তরের নির্বাচনে জাতীয় পরিষদের সদস্য হওয়া ফরিদ গাজী ১৯৭১-এর মার্চে বঙ্গবন্ধু ঘোষিত অসহযোগ আন্দোলন সিলেটে সংগঠিত করেন। মুক্তিযুদ্ধে ৪ ও ৫ নম্বর সেক্টরের বেসামরিক উপদেষ্টা এবং উত্তর-পূর্ব রণাঙ্গনের আঞ্চলিক প্রশাসনিক কাউন্সিলের চেয়ারম্যানের দায়িত্ব পালন করেন তিনি। যুদ্ধপরবর্তী বঙ্গবন্ধুর মন্ত্রিসভায় প্রতিমন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব পালন করা ফরিদ গাজী পঁচাত্তর পরবর্তী সময়ে সামরিক শাসনের বিরোধী ছিলেন। এছাড়া স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখা ফরিদ গাজী ১৯৯৬, ২০০১ ও ২০০৮ সালের জাতীয় নির্বাচনে টানা তিনবার সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন। আওয়ামী লীগের উপদেষ্টামণ্ডলীর সদস্য থাকা ফরিদ গাজী ২০১০ সালের ১৯ নভেম্বর ঢাকায় মারা যান।

সুরঞ্জিত সেন গুপ্ত: বাম আদর্শকে ধারণ করে রাজনীতিতে পা রাখেন ন্যাপ, একতা পার্টি, গণতন্ত্রী পার্টির রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত ছিলেন তিনি। নব্বইয়ের দশকে আওয়ামী লীগের রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত হওয়া সুরঞ্জিত সেন বাংলাদেশের সংবিধান প্রণেতাদের অন্যতম। সত্তরের নির্বাচনে মাত্র ২৫ বছর বয়সে প্রাদেশিক সদস্য নির্বাচিত হয়েছিলেন তিনি। ভাটিবাংলা থেকে তিনি সাত বার সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন। ১৯৯৬ সালে তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সংসদ বিষয়ক উপদেষ্টা পদে থাকা সুরঞ্জিত সেন ২০১১ সালে পান রেলমন্ত্রীর দায়িত্ব। তবে বেশি দিন সে দায়িত্ব পালন করেননি তিনি। পরবর্তীতে তাকে দপ্তরবিহীন মন্ত্রী হিসেবে রাখা হয়। সর্বশেষ আইন, বিচার ও সংসদ বিষয়ক স্থায়ী কমিটির সভাপতি থাকা অবস্থাতেই চলে গেলেন ‘ভাটিবাংলা সিংহ পুরুষ’ হিসেবে খ্যাত সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত।

আবুল মাল আবদুল মুহিত: সাত উজ্জ্বল নক্ষত্রের শেষ জন হয়ে বেঁচে ছিলেন আব্দুল মাল আব্দুল মুহিত। ৮৮ বছর অতিক্রম করে এ নক্ষত্রেরও পতন ঘটলো শুক্রবার (২৯ এপ্রিল) দিনগত ১২টা ৫০ মিনিটে। ১৯৩৪ সালের ২৫ জানুয়ারি সিলেটে জন্মগ্রহণ করেন তিনি। ১৯৫১ সালে সিলেট এমসি কলেজ থেকে উচ্চমাধ্যমিক পাস করেন। ১৯৫২ সালের ভাষা সংগ্রামে সক্রিয় ভূমিকা রাখেন তিনি। ১৯৫৪ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ইংরেজি সাহিত্যে স্নাতক (সম্মান) ও স্নাতকোত্তর সম্পন্ন করেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের স্যার সলিমুল্লাহ হলের ছাত্র সংসদের ভিপি নির্বাচিত হয়েছিলেন তিনি। ১৯৫৬ সালে পাকিস্তান সিভিল সার্ভিস (সিএসপি)-এ যোগদানের মধ্য দিয়ে কর্মজীবন শুরু হয় আবুল মাল আব্দুল মুহিতের। অর্থনৈতিক পরামর্শক হিসেবে ১৯৬৯ সালে যুক্তরাষ্ট্রস্থ পাকিস্তান দূতাবাসে যোগ দেন তিনি। ১৯৭১ সালে বাংলাদেশে মুক্তিযুদ্ধ শুরু হলে জুন মাসে ইস্তফা দেন পাকিস্তানের চাকরি থেকে। মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে যুক্তরাষ্ট্রে জনমত গঠনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখেন তিনি। স্বাধীন বাংলাদেশে ১৯৭২ সালে পরিকল্পনা সচিব এবং ১৯৭৭ সালে অর্থ ও পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়ের বহিঃসম্পদ বিভাগে সচিব পদে নিযুক্ত হন। তিনি ১৯৮১ সালে চাকরি থেকে স্বেচ্ছায় অবসর নিয়ে অর্থনীতি ও উন্নয়ন বিশেষজ্ঞ হিসেবে ফোর্ড ফাউন্ডেশন ও ইফাদ (আইএফএডি)-এ কাজ শুরু করেন।

১৯৮২-৮৩ ও ১৯৮৩-৮৪ অর্থবছরে এরশাদ সরকারের আমলে অর্থ ও পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা ছিলেন তিনি। ওই সময়ে দেশের দুটি বাজেট দেন তিনি। পরবর্তীতে বিশ্বব্যাংক ও জাতিসংঘের বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে পরামর্শক হিসেবে কাজ করেন মুহিত। সেসব শেষে তিনি যোগ দেন আওয়ামী লীগের রাজনীতিতে। মুহিত সর্বপ্রথম জাতীয় নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেন ২০০১ সালে। সেবার সিলেট-১ আসনে আওয়ামী লীগের প্রার্থী হিসেবে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করে বিএনপির সাইফুর রহমানের কাছে পরাজিত হন তিনি। এরপর ২০০৮ সালে নবম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে ফের প্রার্থী হয়ে জয়ের মুখ দেখেন তিনি। ২০০৯ সালের শুরুর দিকে আওয়ামী লীগ সরকার গঠন করলে অর্থমন্ত্রীর দায়িত্ব পান মুহিত। ২০১৪ সালে অনুষ্ঠিত দশম জাতীয় নির্বাচনে বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত হন তিনি। ওই দফায়ও তাকে অর্থমন্ত্রীর দায়িত্ব দেন শেখ হাসিনা।

মুহিত ২০০৯-১০ অর্থবছর থেকে ২০১৮-১৯ অর্থবছর পর্যন্ত টানা ১০টি বাজেট পেশ করেছেন, যা বাংলাদেশে কোনও অর্থমন্ত্রী বা অর্থ উপদেষ্টা হিসেবে একটি রেকর্ড। প্রয়াত অর্থমন্ত্রী সাইফুর রহমানের সঙ্গে একটি রেকর্ডে নাম আছে মুহিতের। দেশে সর্বোচ্চ ১২ বার বাজেট দেওয়ার রেকর্ড সাইফুর ও মুহিতের। প্রায় ষাট বছরের কর্মময় জীবন ছিল মুহিতের। লেখালেখিতেও তিনি ছিলেন সক্রিয়। ইংরেজিতে ১২টিসহ তিনি ৩৫টি বই লিখেছেন।

সংবাদটি শেয়ার করুন

এই সম্পর্কিত আরও নিউজ