সরকার ডোপ টেস্টের দিকে বেশি মনোযোগ দিচ্ছে বলে জানিয়েছেন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল। বলেছেন সরকারি চাকরি পেতে ডোপ টেস্ট লাগবে।
এমনকি বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির সময়ও ডোপ টেস্ট লাগবে। মাদক নিয়ন্ত্রণে খোদ প্রধানমন্ত্রীর কঠোর নির্দেশনা রয়েছে।
মন্ত্রী জানান, বিভিন্ন সময়ে প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশনায় দেশব্যাপী একাধিক অভিযানও হয়েছে। বিভিন্ন অনুষ্ঠানে মাদকের বিরুদ্ধে জিরো টলারেন্স এর কথা বলেছেন তিনি। গণপরিবহন চালকদের নিবন্ধন পেতে ডোপ টেস্টের বাধ্যবাধকতা করার নির্দেশনাও দিয়েছেন তিনি।
কিন্তু, শুধুমাত্র ডোপ টেস্টেই কমবে মাদকের ভয়াবহ আগ্রাসন? সংক্ষেপে উত্তর হল, না। বাস্তবতা হচ্ছে, মাদকের আগ্রাসন এত সর্বগ্রাসী এবং সর্বব্যাপী ছড়িয়েছে যে, এত সহজে মাদক পুরোপুরি নির্মূল করা সম্ভব হবে না।
মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের পরিসংখ্যান বলছে দেশে মাদকাসক্তের সংখ্যা ৭০ লাখ। এর মধ্যে ৮০ শতাংশই তরুণ। এর প্রধান কারণ, মাদকের সহজলভ্যতা। মাদকসেবী, কিন্তু ছাড়তে চান, এমন এক যুবক জানান আরও ভয়ঙ্কর তথ্য। খোদ ঢাকাতেই অনলাইনে অর্ডার করে ডেলিভারি চার্জ পরিশোধ করলেই বাসায় মিলছে মদ, গাঁজা, ইয়াবা, হিরোইন থেকে সম্প্রতি ভাইরাল হওয়া আইসও। গ্রামগঞ্জেও মাদকের প্রভাব ঢাকার মতই। আনাচ-কানাচে সহজেই মিলছে মাদকদ্রব্য।
মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের এক কর্মকর্তা জানিয়েছেন, অবৈধ মাদক আমদানিতে প্রতি বছর কত টাকা পাচার হয়ে যাচ্ছে তার সুনির্দিষ্ট হিসেব কারো কাছে নেই। ৫ শতাংশ মাদকসেবীর ওপর জরিপ চালিয়ে দেখা গেছে, প্রতিদিন গড়ে ১৫০ টাকার মাদক লাগে তাদের। এই হিসেবে বছরে একজন মাদকাসক্ত ৫৪ হাজার ৭৫০ টাকার মাদকদ্রব্য সেবন করেন।
মাদকের প্রায় পুরো অংশই আসছে বিদেশ থেকে। নিত্যনতুন কৌশল অবলম্বন করে পরে তা পৌঁছে দেওয়া হচ্ছে মাদকসেবিদের কাছে। বাংলাদেশের সীমান্ত এলাকার ৩২টি জেলা মাদক চোরাচালানের জন্য চিহ্নিত রুট হিসেবে ব্যবহার হয়। মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের তথ্য মতে বাংলাদেশের সাতক্ষীরা, যশোর, চুয়াডাঙ্গা, মেহেরপুর, চাঁপাইনবাবগঞ্জ, জয়পুরহাট এবং দিনাজপুরের ১৫টি পয়েন্ট দিয়ে নিয়মিত ভারত থেকে মাদক ঢুকছে দেশে।
মূলত, তিন দিক দিয়ে ভারত-বাংলাদেশ সীমান্ত প্রায় ৪ হাজার ১৫৬ কিলোমিটার এবং মিয়ানমারের সঙ্গে ২৭১ কিলোমিটার। ফলে, মাদকের বিস্তার কমানো যাচ্ছে না। মিয়ানমারের সাবাইগন, তমব্রু, মুয়াংডুর মতো ১৫টি পয়েন্ট দিয়ে কক্সবাজার এলাকার প্রায় ৬০-৭০টি পয়েন্ট হয়ে দেশে মাদক ঢুকছে।
আন্তর্জাতিক মাদক চোরাচালানের রুট ‘গোল্ডেন ট্রায়াঙ্গল’ (মিয়ানমার-থাইল্যান্ড-লাওস) এবং গোল্ডেন ক্রিসেন্টের (পাকিস্তান-আফগানিস্তান-ইরান)- একেবারে কেন্দ্রে বাংলাদেশ। এর মধ্যে নতুন করে যোগ হয়েছে রোহিঙ্গাদের মাধ্যমে মাদক আমদানি। এমনকি কুরআন শরিফের ভেতরে করেও মাদক আমদানির মত গর্হিত কাজ তারা করেছেন।
এখানেই শেষ নয়, বিভিন্ন সময়ে পুলিশি অভিযানে বা অন্যান্য বাহিনীর হাতে আটক হওয়া অনেকেই জানিয়েছেন বিভিন্ন রাজনৈতিক নেতার হয়ে তারা মাদক পাচারের কাজ করে থাকেন। অর্থাৎ, ‘ঘরের শত্রু বিভীষণ’। বর্তমানে কিশোর গ্যাং কালচারে জড়িত প্রত্যেকেই মাদকের শিকার।
পরিসংখ্যান যখন এই, তখন শুধুমাত্র কিছু-কিছু ক্ষেত্রে ডোপ টেস্ট করে মাদকের আগ্রাসন নিয়ন্ত্রণে আনা যাবে না। মূলত, ডোপ টেস্টের এই কার্যক্রম আরও বাড়ানোর পাশাপাশি নতুন বেশ কিছু পদক্ষেপ নিতে হবে। সরকারি সব সুবিধা পাওয়ার ক্ষেত্রে ডোপ টেস্ট বাধ্যতামূলক করতে হবে। পাশাপাশি একটি নেটওয়ার্কের আওতায় নিয়ে আসতে হবে এই প্রক্রিয়াকে। বিচ্ছিন্নভাবে করা যাবে না।
বর্তমানে প্রয়োজনের তুলনায় মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের লোকবল অনেক কম। সে কারণে তারাও তেমন সফলতা বয়ে আনতে পারছে না। এ লক্ষ্যে, অধিদপ্তরের কাজ এবং পরিসর, লোকবল বৃদ্ধি করতে হবে। অন্যান্য প্রশাসনিক সংস্থাগুলোকেও রাখতে হবে কার্যকর ভূমিকা। কঠোরভাবে মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ আইনগুলো প্রয়োগ করতে হবে। ব্যাপকভাবে সচেতনতা বাড়ানোসহ সীমান্তে আরও কঠোর ভূমিকা পালন করতে হবে সীমান্তরক্ষী বাহিনীকে।
জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা বলছেন, দীর্ঘস্থায়ী মাদক সেবনের ফলে কিডনি, লিভার ও ফুসফুস মারাত্মক ক্ষতিগ্রস্ত হয়। এমনকি, দীর্ঘমেয়াদে ব্যবহারে নষ্ট হয়ে যেতে পারে যৌন ক্ষমতাও। এছাড়া রক্তচাপ বেড়ে যাওয়া, সন্তান উৎপাদন ক্ষমতা নষ্ট হয়ে যেতে পারে। চূড়ান্ত পরিণতি হতে পারে মৃত্যু।
জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ ও প্রিভেনটিভ মেডিসিন চিকিৎসক ড. লেলিন চৌধুরী বলেন, মাদক শারীরিক, মানসিক, সামাজিক স্বাস্থ্যে প্রভাব ফেলে। মাদক প্রতিরোধের জন্য এলাকাভিত্তিক প্রতিরোধ ব্যবস্থা গ্রহণ এবং এ বিষয়ে সুস্পষ্ট নীতিমালা তৈরি করতে হবে।
এখনই যদি মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণে সুস্পষ্ট পদক্ষেপ না নেওয়া হয়, তবে, আগামীতে যে একটি অসুস্থ প্রজন্ম তৈরি হবে এতে কোনো সন্দেহ নেই। সেটি দেশের সামগ্রিক পরিস্থিতির জন্য বিরাট হতাশার এবং হুমকির। সেরকম হলে সিস্টেম ভেঙে পড়ারও আশংকা আছে। কারণ, আমরা তো জানিই—নগর পুড়লে, দেবালয়ও এড়ায় না।