মৌলভীবাজারের হাকালুকি হাওরে সম্প্রতি জলজ টর্নেডোর ঘটনার পর থেকে এ নিয়ে উদ্বিগ্ন সংশ্নিষ্টরা। তারা বলছেন, দেশে এর আগেও এ ধরনের ঘটনা ঘটেছে কয়েকবার। হাকালুকি হাওরে জলজ টর্নেডো নিয়ে ইতোমধ্যে তথ্য সংগ্রহ ও ভবিষ্যৎ অবস্থা নিয়ে বিশ্নেষণ করছেন আবহাওয়াবিদরা। তাদের আশঙ্কা, অনাবৃষ্টি ও তাপদাহে বাড়ছে ভূপৃষ্ঠের উষ্ণতা। এতে আগামীতে জল ও স্থলে আরও টর্নেডো আঘাত হানতে পারে। ফলে বাড়াতে হবে জনসচেতনতা।
হাকালুকির বারহালি চাতলা বিলে গত শনিবার সন্ধ্যার দিকে হঠাৎ হাওরের পানি কুণ্ডলী পাকিয়ে ওপরে উঠে যায়। এ ঘটনায় এলাকায় ব্যাপক চাঞ্চল্য দেখা দেয়। বিষয়টি নিয়ে একেকজন একেকভাবে ব্যাখ্যা দিচ্ছেন।
আবহাওয়া অধিদপ্তরের উপ পরিচালক ছানাউল হক মণ্ডল বলেন, বঙ্গোপসাগর ও জলাভূমিগুলোতে প্রায় প্রতি বছর ছোট ছোট টর্নেডো আঘাত হানার তথ্য মেলে। তবে ১৯৮৯ সালের ২৬ এপ্রিল মানিকগঞ্জের সাটুরিয়া, ২০১৩ সালে ব্রাহ্মণবাড়িয়া ও ২০১৪ সালে নেত্রকোনায় প্রলয়ঙ্করী টর্নেডোর আঘাতে অসংখ্য প্রাণ ও সম্পদহানি হয়। অনাবৃষ্টি ও তাপদাহে ভূপৃষ্ঠের উষ্ণতা বাড়ার কারণেই আগামীতে জল ও স্থলে টর্নেডো আরও বাড়তে পারে।
কানাডার সাসকাচুয়ান ইউনিভার্সিটির আবহাওয়া ও জলবায়ুবিষয়ক গবেষক মোস্তফা কামাল পলাশ বলেন, প্রতিদিন টর্নেডো হয় না। হাকালুকি হাওরে যে ঘটনা ঘটেছে, তা প্রতিদিন দেখা যায় না। কারণ এ ঘটনা ঘটার জন্য যে প্রাকৃতিক শর্ত পূরণ করতে হয়, সেরকম পরিবেশ সব সময় দেখতে পাওয়া যায় না।
ওয়াটারস্পাউট বা জলজ টর্নেডো সৃষ্টির জন্য প্রকৃতিকে চারটি আবশ্যকীয় শর্ত পূরণ করতে হয় জানিয়ে এ আবহাওয়া গবেষক বলেন, বায়ুর উচ্চ তাপমাত্রা, বায়ুতে পর্যাপ্ত জলীয় বাষ্পের উপস্থিতি, বায়ুপ্রবাহের দিক ভূপৃষ্ঠ থেকে বিভিন্ন উচ্চতায় বিভিন্ন দিকে ও প্রাকৃতিক বা যান্ত্রিক বলের উপস্থিতি থাকতে হয়। শনিবার হাকালুকি হাওরে চারটি শর্তই উপস্থিত ছিল।
মোস্তফা কামাল পলাশ বলেন, বিষয়টি স্থলভাগে সংঘটিত হলে আবহাওয়া বিজ্ঞানের ভাষায় সেটিকে বলা হতো টর্নেডো। টর্নেডো খুব শক্তিশালী হলে যেমন বড় বড় বস্তুও ওপরে উঠিয়ে নিয়ে যায়, ঠিক একইভাবে ওয়াটারস্পাউট জলভাগ থেকে মাছ-ব্যাঙসহ অন্য জলজপ্রাণী ওপরে উঠিয়ে নিয়ে যায়। ওয়াটারস্পাউটের ফলে সৃষ্ট জলীয় বাষ্প যখন অন্য স্থানে বৃষ্টি হিসেবে ভূমিতে পতিত হয়, তখন ওই বৃষ্টির সঙ্গে সেসব মাছ ও ব্যাঙ ভূপৃষ্ঠে পড়ে।
আবহাওয়া অধিদপ্তর সিলেটের জ্যেষ্ঠ আবহাওয়াবিদ সাঈদ আহমেদ চৌধুরী বলেন, জলভাগে এ ধরনের টর্নেডো তেমন ক্ষতি করতে পারে না। তবে এর ব্যাপ্তি ১০-১২ কিলোমিটার হতে পারে। ঘূর্ণনের গতিসীমায় যা পড়বে, তা ওপরে তুলে নেবে। ওই স্থানে কালো মেঘ জমে বিজলি চমকায় এবং বিকট শব্দ হয়। তবে লম্বা পিলার আকারের স্তম্ভের নিচে মাটি ও পানির সংস্পর্শে থাকলে সেটি প্রলয়ঙ্কর রূপ ধারণ করে সবকিছু মাটিতে মিশিয়ে দেয়।
আবহাওয়াবিদরা বলছেন, ভূমিকম্পের মতো টর্নেডোর আগাম সতর্কসংকেত জারি করতে পারে না আবহাওয়া অধিদপ্তর।
অধিদপ্তরের জ্যেষ্ঠ আবহাওয়াবিদ আবদুল মান্নান বলেন, অন্য টর্নেডোর তুলনায় হাকালুকির টর্নেডোটি ব্যতিক্রম ছিল। এর ফানেলটির দৈর্ঘ্য কমপক্ষে ৫০০ মিটার বা আধা কিলোমিটার বলে মনে হয়েছে।
তিনি বলেন, গত এক যুগে দেশে টর্নেডোর আঘাত হানার প্রবণতা বেড়েছে। আগে সাধারণত আমরা চার থেকে পাঁচ বছর পরপর টর্নেডো আঘাত হানতে দেখেছি। সাম্প্রতিক বছরগুলোয় আমরা দেখছি, প্রায় প্রতি বছরই দেশের বিভিন্ন স্থানে ছোটখাটো টর্নেডো আঘাত হানছে। এতে স্থানীয়ভাবে ক্ষয়ক্ষতি হচ্ছে।
টর্নেডোর পূর্বাভাসের বিষয়ে আবদুল মান্নান বলেন, এখনও সঠিকভাবে পূর্বাভাস দেওয়া সম্ভব নয়। এ কারণে আমাদের টর্নেডোর ক্ষতি মোকাবিলার উপযোগী করে বাড়িঘর নির্মাণ করতে হবে। এ ছাড়া কোথাও টর্নেডো শুরু হলে পাকা ভবন ও শক্তিশালী কোনো অবকাঠামোর মধ্যে আশ্রয় নিতে হবে।