বাউল গানের মাধ্যমে তরুণ শ্রোতাদের আকৃষ্ট করতে চান দীপ্তি সরকার

  • বিশেষ প্রতিনিধি
  • প্রকাশ: ৬ সেপ্টেম্বর ২০২২, ১:৫৪ অপরাহ্ণ | আপডেট: ২ বছর আগে
  • Print

এপ্রজন্মের আলোচিত ও জনপ্রিয় বাউল শিল্পী  দীপ্তি সরকার । বাউল গান ও তত্ত্ব  অনুসন্ধানে আত্ম নিয়োজিত করছেন। দীর্ঘ দুই দশক ধরে বাউল গান পরিবেশন, সাধনা ও গবেষণায় করে যাচ্ছেন নিরালসভাবে। বাউল পরিবারের জন্মগ্রহণ করায় পারিবারিক পরম্পরায় অল্প বয়সে বাউল তত্ত্বে পরিচিতি ঘটে।

‘ঘর বেধেছি বালুর চরে ভাঙ্গন নদীর তীরে’ খ্যাত এক সময়কার সাড়াজাগানো বাউল শিল্পী আব্দুল গনি সরকার এর মেয়ে দীপ্ত সরকার । দীপ্তি সরকার বাবার মতো বাউল গানে আত্ম নিয়োজিত করেন ছোট বেলা থেকেই।মাত্র পাঁচ বছর বয়স থেকেই গানে হাতেখড়ি বাবা ও মায়ের হাত ধরে। তিনিও ভালোবেসে বাউল গান পরিবেশন করেন বিভিন্ন অনুষ্ঠানে যখন তার বয়স মাএ পাঁচ বছর। কালজয়ী প্রয়াত বাউল শিল্পী আব্দুল গনি সরকার এর সান্নিধ্যে চলে বাউল গান ও তত্ত্ব তালিম।সেই থেকে গত চার বছর আগে প্রয়াত হওয়ার আগ মুহূর্ত পর্যন্ত শিক্ষা নিয়েছেন।

 

পাঁচ দশকের বিখ্যাত ও সুপরিচিত বাউল গান ও তত্ত্বের পারদর্শী আব্দুল গনি সরকার  দীপ্তি সরকার এর পিতা ও গুরু।  তিনি সারাদেশের নিয়মিতভাবে পাঁচ দশক ধরে  বাউল গান পরিবেশন করেন মোহিত করে রেখেছেন। স্বাধীনতার উওর বাংলাদেশ যে কয়েকজন বাউল গান প্রতিনিধিত্ব করতেন, স্বনামধন্য  জনপ্রিয় বাউল  আব্দুল গনি সরকার ছিলেন অন্যতম। বাউল তত্ত্ব ও গানে আব্দুল গনি সরকার ছিলেন অদ্বিতীয়, তাঁর সুরালা কন্ঠ মোহিত করতো শ্রোতাদের।  তিনি দীর্ঘ ৫০ বছর বাউল চর্চায় নিয়োজিত ছিলেন। কঠিন তত্ত্ব ও গান খুব সহজেই যুক্তি দিয়ে মানুষকে  হৃদয় স্পর্শ করতে পারতেন,আসরে রচনা করতেন নতুন গানের।

‘ভালোবাসি বলে বন্ধু আমায় কাঁদালে’, ‘ঘর বেঁধেছি বালুর চরে’ ‘নিদয়া নিঠুরও বন্ধুরে’ মতো শতাধিক বহুল শ্রুত ও জনপ্রিয় গান রয়েছে তার ঝুলিতে। গনি সরকারের অ্যালবাম এর সংখ্যা পঁচিশর অধিক। এছাড়াও বিভিন্ন শিল্পীর কন্ঠে পরিবেশিত গানের সংখ্যা দুই শতাধিক। তাঁর মৌলিক গানের সংখ্যা তিনশোর।

সালেহা বেগম দেশের প্রবীণ ও জনপ্রিয় বাউল  শিল্পী। তিনিও দীর্ঘ পঞ্চাশ বছর ধরে বাউল গান পরিবেশন করেন, দেশের বিভিন্ন প্রান্তে। তাঁর মৌলিক অনেক গান আছে। সালেহা বেগম এই দীপ্তি সরকারের মাতা ও গুরু।

দীপ্তি সরকার এর ছোটবেলা কেটেছে পিতা ও মাতার স্বানিন্ধে বাউল আবহে মিরপুরে নিজেদের বাড়িতে। ছোটবেলা থেকেই বাউল গান পরিবেশন করলেও লেখাপড়া তিনি মেধাবী হিসেবে পরিচিত। মিরপুর সিদ্ধান্ত হাই স্কুল থেকে এস এস সি, সরকারি সংগীত কলেজ থেকে এইচএসসি (লোক গীতি) সম্পন্ন করেন। মিরপুর শাহ্ আলী মহিলা কলেজ থেকে ইংরেজী (অনার্স) করেন। বর্তমান ইংরেজীতে মাস্টার্স অধ্যায়নরত। তিনি সু্যোগ পেলে আরো উচ্চতর শিক্ষা নিতে চান। বাউল বা লোকসংগীত নিয়ে আছে বিশেষ পরিকল্পনা।

দীপ্তি সরকারের ২০১৬ সালে প্রথম আলব্যাম ‘গানের তাজমহল’ প্রকাশ পায় ও তুমুল জনপ্রিয়তা অর্জন করে। এর ধারাবাহিকতায় ‘ভুলে ভরা বিশ্ব’, ‘মায়ার মানুষ’,‘কি মায়া লাগাইলায়’ ও ‘মনের মতো মানুষ’ সহ বেশকিছু অ্যালবাম আছে। বর্তমান তিনি আর অ্যালবাম না করে সিঙ্গাল গান প্রকাশ করছেন বিভিন্ন ইউটিউব চ্যানেলে।তার মৌলিক গানের সংখ্যা দুই শতাধিক।

গীতিকার জাহাঙ্গীর রানা কথায় ‘সার্থের দুনীয়ায়’, গীতিকার আব্দুল সোবাহান সরকারের কথায়, ‘আমায় যদিগো ভালোবেসে থাকো’, গীতিকার শরীফা বেগমের কথায়, ‘মায়ার একটা মানুষ ছিলো’, গীতিকার আলেয়া বেগমের কথায় ‘আমার কাছে সুখ পাওয় নি বলে’ এর মত বহুল জনপ্রিয় পঞ্চাশটির গান রয়েছে তার গাওয়া। তিনি নিয়মিতভাবে মৌলিক গান গেয়ে বিভিন্ন ইউটিউব চ্যানেল রিলিজ করছেন।

দীপ্তি সরকার দেশের প্রায় সকল টেলিভিশন চ্যানেল লোক ও বাউল গান পরিবেশন করেছেন। এখন নিয়মিতই করে যাচ্ছেন। বাউল গান হলো আদি শিল্পরুপ।এটা লোকায়িত শিল্প হিসেবেও পরিচিত। বাউল গান হলো বাংলার মাটি ও মানুষের মনের অনুভূতি গান।

বাউল গান দুইজন শিল্পী দুটো দলে বিভক্ত হয়ে নির্ধারিত বিষয় যুক্তি উপস্থাপন ও বিচ্ছেদ গান পরিবেশন করে। বাউল গান মূলত লোক সাহিত্য,কেতাব, সাহিত্য, বিজ্ঞান, ধর্ম,দেহতত্ত্ব ও নৈতিকতা নিয়ে আলোচনা, তর্ক ও যুক্তি উপস্থাপন করে। পালা শেষ একটা সীদ্ধান্তে পৌঁছে ও একজন বা দল বিজয়ী হয়।

বাউল গান পরিবেশন দীপ্তি সরকারের মূল সাধনা। তিনি প্রতিনিয়ত বাউল গান করেন ও ভালবাসেন‌। আজীবন বাউল গানের মধ্যে নিজেকে ডুবিয়ে রাখতে চান।

ফোক বা লোক বিচ্ছেদী গানের মাধ্যমে তরুণ শ্রুতাদের বাউল গানে আকৃষ্ট করতে চান। বাউল অঙ্গনে আধুনিক গান পরিবেশন করতে ও আগ্রহী ।

চলচ্চিত্র গান এর প্রতি তার বিশেষ আগ্রহ আছে। বর্তমান সময়ের আলোচিত সিনেমা ‘হাওয়া’ সাদা সাদা কালা কালা গানটিও লোক সংগীত। এমন অনেক গান আছে বাউল শিল্পী দের গাওয়া, যা সিনেমায় ব্যবহার করলে লোকসংগীত আরো সমৃদ্ধ হবে। তিনি সিনেমার কন্ঠ দেয়ার সুযোগ পেলে অবশ্যই কন্ঠ দিবেন। তবে নাটকেও বর্তমান সময় আবাহ সংগীত ব্যবহার করছে, সেখানেও বাউল গান ব্যবহার করতে পারে।

দীপ্তি সরকার বাংলাদেশ সরকারের ‘সংস্কৃতি মন্ত্রণালয়ের’ তালিকাভুক্ত বাউল শিল্পী । তিনি সংস্কৃতি মন্ত্রণালয়ের বিভিন্ন অনুষ্ঠানে অংশগ্রহণ করেন। বাংলাদেশ বাউল সমিতির শাখা কার্যালয় চাঁদপুর এর সাধারণ সম্পাদক ও বাংলাদেশ বাউল সমিতির কেন্দ্রীয় কমিটির, কার্যনির্বাহী সদস্য দায়িত্ব পালন করছেন।

দীপ্তি সরকারের মতে, ‘মাটির মানুষ মাটির ভাষায় কথা ও গান সহজে বুঝতে পারে, উপলব্ধি করতে পারে, জীবন গঠন করতে সাহায্য করে। বাউল তত্ত্ব হলো স্রষ্টার সাথে সৃষ্টির আধ্যাত্বিক সত্ত্বার সমন্বয়। সৃষ্টি তখনই স্রষ্টার সন্নিকটে পৌঁছাতে পারে, যখন তার নিজের সমন্ধে আত্ম উপলব্ধি হয়।’

দীপ্তি সরকার আরো বলেন, সংগীত মানুষের মনের অনুভূতি প্রকাশ করে।বাউল গান ও তত্ত্ব সহজ মনের ভাষা প্রকাশ করতে পারে।

বাউল গান মানুষ এর মনন ও সমাজ গঠনে ভূমিকা রাখছে,সহজেই হৃদয় স্পর্শ করে। তরুণদের এই গান আরো বেশি করে শোনালে ও উপলদ্ধি করলে সমাজ মানবিক হবে, বলে দীপ্তি সরকার মনে করেন।

ইংরেজি সাহিত্যে উচ্চ শিক্ষিত হয়েও কেন বাউল গানে বা অন্য পেশায় নিয়মিত হওয়ার ইচ্ছা আছে কিনা? এ প্রসঙ্গে তিনি বলেন, বাউল গানের মধ্যে নিজেকে পুরোপুরি আত্মনিয়োজিত করতে চাই। বাউল গান এবং শুধু বাউল গান আমার ধ্যান। বাউল গানকে বিশ্বের কাছে তুলে ধরতে চাই।

সংবাদটি শেয়ার করুন

এই সম্পর্কিত আরও নিউজ