সারছেনা ক্রটি, কাটছেনা জন্ম নিবন্ধন জটিলতা : ভোগান্তির নাম সার্ভার ডাউন

  • বিশেষ প্রতিনিধি
  • প্রকাশ: ১৬ সেপ্টেম্বর ২০২৩, ৭:৪১ পূর্বাহ্ণ | আপডেট: ১ বছর আগে
  • Print

নগরীর আখালিয়া সুরমা আবাসিক এলাকার বাসিন্দা রুমেল আহমদ। ছেলেকে স্টুডেন্ট ভিসায় যুক্তরাষ্ট্রে পাঠাতে ভিসা প্রসেসিং করছেন। কিন্তু করোনা টিকার সনদের নামে ভুল থাকায় গত ১ মাস ধরে জন্ম নিবন্ধনের জন্য সিলেট সিটি কর্পোরেশন এবং টিকা সনদের জন্য তথ্য প্রযুক্তি অধিদপ্তর সিলেট কার্যালয়ে ধরনা দিচ্ছেন। দুই জায়গাতেই সমস্যা একটাই সার্ভার ডাউন। ফলে ভিসা প্রসেসিং শেষ পর্যায়ে চলে আসলেও এখনো সংশোধনী পাননি জন্ম নিবন্ধন এবং টিকা সনদের। ফলে অনিশ্চয়তায় আছেন এই অভিভাবক।

শুধু রুমেল নয়, জন্ম নিবন্ধনের এমন সমস্যায় চরম ভোগান্তিতে পড়েছেন সেবা নিতে আসা অসংখ্য সাধারণ মানুষ। বাধ্য হয়ে অনেকেই দালালের আশ্রয় নিচ্ছেন, কেউবা ঘুরছেন সিটি কর্পোরেশন সহ সংশ্লিষ্ট দপ্তরে দপ্তরে। কিন্তু সমাধানের পথ খুঁজে পাচ্ছেনা কেউ। এমন কাজে বিপাকে পড়েছে জন্ম নিবন্ধন কাজের সেবাদানকারী প্রতিষ্ঠান সিসিকের স্বাস্থ্য বিভাগ। সংশ্লিষ্টরা বলছে গত ৩ মাস ধরে জন্ম নিবন্ধন সার্ভার ডাউন সহ নানা ত্রুটির কারণে নানা সমস্যায় পড়েছেন তারা।

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, গত ৩ মাস ধরে সারাদেশে বন্ধ আছে জন্মনিবন্ধন সনদপত্রের সংশোধন কার্যক্রম, ফলে জরুরি বিদেশ যাত্রা, চিকিৎসা বা স্কুলে ভর্তির মতো ১৮টি রাষ্ট্রীয় সুযোগ সুবিধা নিতে ভোগান্তিতে পড়ছে সাধারণ মানুষ। মাঝে মাঝে চালু থাকলেও অনুন্নত সার্ভারের কারণে ধীরগতিতে চলছে নতুন নিবন্ধনও। জন্মসনদ নিবন্ধন সফটওয়্যার আপডেট করা হচ্ছে জানিয়ে জন্ম-মৃত্যু নিবন্ধন রেজিস্টার জেনারেল বলছেন শিগগিরই মিটে যাবে এই সমস্যা। তবে গত ৩ মাসেও এর সমাধান মিলেনি। কবে মিলবে এর সুনির্দিষ্ট তথ্য নেই কারো কাছে। ফলে সহসা জন্ম নিবন্ধন জনিত কাজের ভোগান্তি দূর হওয়ার সম্ভাবনা নেই।

জানা গেছে, ২০১০ সাল থেকে শুরু হয় জন্মনিবন্ধনের অনলাইন কার্যক্রম, একই সঙ্গে চলতে থাকে পূর্বের সনদপত্রগুলোর অনলাইন হালনাগাদকরণ। গত ৩ মাস যাবৎ বন্ধ রয়েছে জন্মনিবন্ধনের সংশোধন কার্যক্রম, ফলে বিভিন্ন নাগরিক সুবিধা থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন সাধারণ মানুষ। তারা বলেন, পাসপোর্ট পাচ্ছি না। তাহলে ভিসা পাবো কিভাবে? রেজিস্ট্রেশন করাতে পারছি না। নতুন করে জন্মনিবন্ধন করতে এসেও ভোগান্তিতে পড়ছেন নাগরিকরা। নিবন্ধন কেন্দ্রগুলো বলছে, মাঝে মধ্যেই দুই-তিনদিন পর্যন্ত অকার্যকর হয়ে পড়ে নিবন্ধন সার্ভার। আর ধীরগতির কারণে দিনের পর দিন ঘুরতে হয় সেবা গ্রহীতাদের।

ভুক্তভোগীরা বলেন, আসলেই বলে সার্ভারে সমস্যা। দু তিন দিন পর সময় দেয়। বারবার আসতে হয়। ২০১০ সালের অনুন্নত সার্ভার দিয়ে একযোগে সাড়ে পাঁচ হাজার কেন্দ্রে কার্যক্রম চলছে ফলে বেশ বেগ পেতে হচ্ছে জানিয়ে জন্ম-মৃত্যু রেজিষ্টার জেনারেল মানিক লাল বণিক বলছেন, সার্ভারটি আধুনিকায়নের কার্যক্রম চলছে। পুরনো সিস্টেমের আপগ্রেড চলছে। আপগ্রেড হলে আর ভোগান্তি থাকবে না।

সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, গত ২৭ আগস্ট জন্ম ও মৃত্যু নিবন্ধন রেজিস্ট্রার জেনারেল (অতিরিক্ত সচিব) মোঃ রাশেদুল হাসান স্বাক্ষরিত এক বিজ্ঞপ্তিতে দৈনিক ৩০টি জন্ম নিবন্ধন করা হবে বলে নির্দেশনা দেয়া হয়।

এই বিজ্ঞপ্তি প্রকাশের পর থেকে একটি ইউজার আইডি থেকে সার্ভারে গিয়ে ৩০ টি নিবন্ধন রেজিস্ট্রেশন হচ্ছে। এরপর স্বয়ংক্রিয়ভাবে রেজিস্ট্রেশন বন্ধ হয়ে যাচ্ছে। ঐ বিজ্ঞপ্তিতে সিটি কর্পোরেশনের ওয়ার্ড পর্যায়ে ৩০টি এবং জোন পর্যায়ে সর্বোচ্চ ১০০টি আবেদন রেজিস্ট্রেশনের কথা থাকলেও সেদিন থেকে ৩০টির বেশী আবেদন যাচাই ও রেজিস্ট্রেশন করতে পারছিলনা খোদ সিলেট সিটি কর্পোরেশনের জন্ম নিবন্ধন বিভাগ। এ নিয়ে চলতি মাসের ২ সেপ্টেম্বর দৈনিক জালালাবাদে সংবাদ প্রকাশ করা হয়। এরপর থেকে সিটি কর্পোরেশনকে দৈনিক ১০০টি নিবন্ধন রেজিস্ট্রেশনের ক্ষমতা দেয়া হয়। কিন্তু সার্ভার ডাউন সংক্রান্ত জটিলতার কারণে গড়ে ৫০টি নিবন্ধনও রেজিষ্ট্রেশন করতে পারছেন না তারা। ভোগান্তির পরও নতুন নিবন্ধন দেয়া সম্ভব হলেও ২ মাসের বেশী সময় ধরে সংশোধন কার্যক্রম প্রায় পুরোপুরি বন্ধ রয়েছে। মাঝে মাঝে চালু হলেও সার্ভার ঢুকার সাথে সাথেই ডাউন হয়ে যাচ্ছে।

এমন সমস্যা শুধু সিলেট সিটি কর্পোরেশনই নয়, সকল ইউনিয়ন পর্যায়ে। সেসব এলাকায় জন্ম নিবন্ধন ভোগান্তি আরো চরম। এ বিষয়ে শহরতলীর কয়েকটি ইউনিয়নের সচিবদের সাথে কথা বলে জানা গেছে, সার্ভার আপডেটের কার্যক্রম চলমান এবং যান্ত্রিক ত্রুটির কারণে প্রায় ৩ মাসের মতো সময় ধরে সার্ভার বন্ধ রয়েছে। এতে করে জন্মনিবন্ধন সনদ প্রদান, ভুল ত্রুটি সংশোধন কার্যক্রম বন্ধ রয়েছে। মৃত্যুসনদ প্রদানের প্রথম শর্ত হলো তার জন্মনিবন্ধন সনদ দিতে হবে, তারপরে মৃত্যুসনদ প্রদান করা হবে। কিন্তু সার্ভার না থাকার কারণে জন্মনিবন্ধন বের না হওয়ার কারণে মৃত্যুসনদ প্রদান কার্যক্রমও বন্ধ রয়েছে। এই দু’টি বিষয় নিয়ে আমরা খুব সমস্যার মধ্যে পড়েছি। জনগণকে বেশ ভোগান্তি পোহাতে হচ্ছে। কিন্তু ৩ মাস হয়ে গেল। আর কতদিন লাগবে বলা যাচ্ছে না। যদিও নতুন করে জন্ম নেওয়া শিশুদের জন্মনিবন্ধন সনদ প্রদান কার্যক্রম চলমান রয়েছে। তবে এই সংখ্যাও সীমিত করা হয়েছে। দৈনিক ৩০টির বেশী জন্ম নিবন্ধন রেজিস্ট্রেশন করা যাচ্ছেনা। ৩০ টি আবেদন রেজিস্ট্রেশন করতে গেলেও অনেক সময় ব্যয় করতে হচ্ছে। কারণ ১ টা রেজিস্ট্রেশন করার পরই সার্ভার ডাউন হয়ে যাচ্ছে। ফলে পরবর্তী রেজিস্টেশন করতে আমাদেরকে বেগ পেতে হচ্ছে।

এ ব্যাপারে সিলেট সিটি কর্পোরেশনের জন্ম নিবন্ধন বিভাগের দায়িত্বে থাকা সিসিকের প্রধান স্বাস্থ্য কর্মকর্তা ডা. জাহিদুল ইসলাম দৈনিক জালালাবাদকে বলেন, গত ৩ মাস ধরে জন্ম নিবন্ধনের সার্ভার জটিলতায় আমরা বড় বিপাকে পড়েছি। এর ফলে সেবা নিতে আসা জনসাধারণ সীমাহীন ভোগান্তির শিকার হচ্ছেন। কিন্তু এ ব্যাপারে আমাদের করণীয় তেমন কিছু নেই। গত ২ মাসের অধিকাংশ সময় বন্ধ থাকার পর চলতি মাসের শুরুতে জন্ম নিবন্ধন সার্ভার খুলে দেয়া হলেও দৈনিক ৩০টি রেজিস্ট্রেশন লিমিট করে দেয়া হয়। এ নিয়ে গণমাধ্যমে লেখালেখি হলে আমাদের লিমিট ৩০ টি থেকে ১০০টি করা হয়। এরপর থেকে আমরা দৈনিক ১০০টি নিবন্ধন রেজিস্ট্রেশনের ক্ষমতা পেলেও সার্ভার জটিলতার কারণে ৫০টিও করতে পারছিনা। এরমধ্যে নতুন যোগ হয়েছে বিল রিসিভ সংক্রান্ত সমস্যা।

তিনি বলেন, জন্ম নিবন্ধনের সবধরনের আবেদনে ৪টি পার্ট থাকে। এরমধ্যে শুধু ১ম ধাপের অনলাইন আবেদনটি গ্রাহক নিজেরা করেন। বাকী ৩টি ধাপ আমরা করে থাকি। এরমধ্যে ২নং ধাপে থাকে বিল-রিসিভ, ৩নং ধাপে নিবন্ধন এপ্রোভাল (রেজিস্ট্রেশন ডান) ও ৪র্থ-শেষ ধাপে প্রিন্ট। কিন্তু বর্তমানে বিল রিসিভ সংক্রান্ত সমস্যা আরো প্রকট হয়েছে। অনলাইনে কিংবা বিভিন্ন মোবাইল পরিসেবার মাধ্যমে বিল পেমেন্ট করা হলে সাথে সাথে বিল কেটে নিচ্ছে ঠিকই। কিন্তু অনলাইন সার্ভারে পেমেন্ট দেখাচ্ছেনা। আর পেমেন্ট রিসিভ না দেখালে নিবন্ধন এপ্রুভালও করা যাচ্ছেনা। ফলে সবকিছু ঠিক থাকা সত্ত্বেও একজন গ্রাহক ভোগান্তির সম্মূখীন হচ্ছেন। এ বিষয়ে আমরা উর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষকে অবহিত করেছি। কিন্তু দ্রুত সমাধানের কোন লক্ষণ দেখতে পাচ্ছিনা।

সংবাদটি শেয়ার করুন

এই সম্পর্কিত আরও নিউজ