রাজধানীর কারওয়ানবাজারে অফিস শেষে রাত পৌনে ১০টায় বের হন একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের একজন কর্মকর্তা। তখন মুষলধারে বৃষ্টি ঝরছিল। মোহাম্মদপুরের শেখেরটেকের বাসায় পৌঁছাতে তাঁর সময় লেগেছে প্রায় তিন ঘণ্টা। শুধু তিনিই নন, টানা প্রায় ছয় ঘণ্টার ভারী বৃষ্টিতে রাজধানীর প্রধান সড়কসহ অলিগলিতে সৃষ্ট জলাবদ্ধতায় যান চলাচল ব্যাহত হয়ে ভোগান্তিতে পড়েছেন কর্মক্ষেত্র থেকে ঘরে ফেরা মানুষজন। লম্বা সময় ধরে একই স্থানে আটকে আছে অসংখ্য যানবাহন। দীর্ঘ সময় ধরে ঘুরছে না গাড়ির চাকা। অফিসে শেষে মোটরসাইকেলে কুড়িল থেকে মোহম্মদপুর যাচ্ছিলেন কালাম খান। সন্ধ্যা থেকে পথে আটকে আছেন তিনি।কালাম বলেন, ‘পানিতে বাইক ডুবে যাওয়ার উপক্রম। যে বৃষ্টি, এর মধ্যে গাড়ি চালানো রিস্কি। তাই বাধ্য হয়ে দাঁড়িয়ে আছি। কখন বৃষ্টি কমবে আর কখন বাড়ি ফিরব জানি না।’ এদিকে আবহাওয়া অফিস জানিয়েছে, বৃষ্টি থাকবে আরো দুই দিন।
ঢাকায় বৃহস্পতিবার সন্ধ্যার পর থেকে মধ্যরাত পর্যন্ত তুমুল বৃষ্টি হয়। সঙ্গে চলে বজ্রপাত ও দমকা হাওয়া। মিরপুরে কমার্স কলেজ–সংলগ্ন ঝিলপাড় বস্তির বিপরীত পাশে জলাবদ্ধ সড়কে বিদ্যুতের তাঁর ছিঁড়ে পড়ে। এতে জলমগ্ন সড়কে বিদ্যুৎস্পৃষ্ট হন একই পরিবারের চারজন। তাঁদের তিনজনই মারা গেছেন। ওই পরিবারের সাত মাস বয়সী এক শিশু গুরুতর অবস্থায় ঢাকার একটি হাসপাতালে চিকিৎসাধীন। পুলিশের ভাষ্যমতে, এই পরিবারকে বাঁচাতে গিয়ে আরেক তরুণ বিদ্যুৎস্পৃষ্ট হয়ে মারা গেছেন।
ভারী বৃষ্টিতে সৃষ্ট জলাবদ্ধতার কারণে রাজধানীর বিভিন্ন সড়কে কার্যত যান চলাচল বন্ধ হয়ে যায়। বৃষ্টি শেষে যান চলাচল শুরু হলে সড়কে দেখা দেয় গাড়ির চাপ। এতে মধ্যরাতেও রাজধানীর বিভিন্ন এলাকায় দেখা দেয় তীব্র যানজট। বৃষ্টির কারণে অনেক এলাকায় বিদ্যুৎ–সংযোগ বিচ্ছিন্ন হয়েছে বলেও জানা গেছে।
কারওয়ানবাজারের বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের ওই কর্মকর্তা প্রথম আলোকে বলেন, অফিসের সিএনজিচালিত অটোরিকশায় করে এক সহকর্মীর সঙ্গে বাসার উদ্দেশে রওনা দেন তিনি। পথে বিজয় সরণিতে পানি ঢুকে অটোরিকশাটি বন্ধ হয়ে যায়। তখন অটোরিকশা থেকে নেমে রিকশায় করে কলেজ গেট পর্যন্ত পৌঁছান তিনি। সেখানে তাঁর স্বামী মোটরসাইকেলে এসে তাঁকে শেখেরটেকের বাসায় নিয়ে যান। তখন ঘড়িতে বাজে রাত সাড়ে ১২টা। সঙ্গে থাকা সহকর্মী তখনো কল্যাণপুরের বাসায় পৌঁছাতে পারেননি।
রাস্তায় জমে থাকা পানির কারণে বাসায় ফিরতে গিয়ে একই অভিজ্ঞতার মুখে পড়েন সাংবাদিক তুহিন সাইফুল্লাহ। রাত সাড়ে ১২টার দিকে তিনি বলেন, কারওয়ানবাজারে অফিস থেকে বের হয়ে প্রায় ৪০ মিনিট ফার্মগেটে আটকে রয়েছেন। জলজটের কারণে যানবাহন থেমে থেমে চলছে। তখনো হালকা বৃষ্টি ঝরছিল। তিনিও যাবেন মোহাম্মদপুরে।
মধ্যরাতে ভোগান্তির কথা তুলে ধরে আরেক সাংবাদিক ফেসবুকে লিখেছেন, ‘মহাখালী থেকে শেওড়াপাড়া আসতে প্রায় ৪ ঘণ্টা! এখন রাত ১টা। বাসায় যাব কখন?’
মধ্যরাতে যানজটের এ চিত্র পুরো নগরীতেই। এর আগে বৃষ্টি ও জলাবদ্ধতায় রাত ১১টার দিকে রাজধানীর বেগম রোকেয়া সরণিতে কয়েক শ গাড়ি আটকা পড়ে। এর আধা ঘণ্টা আগেই তলিয়ে যায় গ্রিন রোড এলাকা। রাত সোয়া ১০টার দিকে ওই সড়কে বহু গাড়ি আটকে থাকতে দেখা যায়। মিরপুর, ধানমন্ডি, নীলক্ষেত, কাঁটাবন, হাতিরপুল এলাকার সড়কেও একই চিত্র।
জলজট ও যানজটের মধ্যে বাড়তি রিকশা ভাড়া নিয়ে অভিযোগ করতে দেখা গেছে অনেককে। ফেসবুকে একজন লিখেছেন, ‘পান্থপথ সিগন্যাল থেকে সেন্ট্রাল রোডে রিকশা ভাড়া চাইল ২০০ টাকা। একজন না অনেকজন রিকশাওয়ালা। মূল্যবৃদ্ধি নিয়ে অবাক হওয়ার কিছু নেই। আমাদের মাঝে জিম্মি করার প্রবণতা বেশি। সব পেশাজীবীদের মাঝেই।’
এদিকে রাত নয়টার দিকে ধানমন্ডি ১৪ নম্বরের ২২ নম্বর বাড়ির সামনে একটি কড়ই গাছ ভেঙে সড়কের ওপর পড়ে। এতে কেউ হতাহত হননি। তবে রাস্তায় তীব্র যানজট লেগে যায়। ফায়ার সার্ভিস বলছে, গাছটি এতই বড় যে তা তাদের পক্ষে সরানো সম্ভব হয়নি। রাতে ফায়ার সার্ভিসের নিয়ন্ত্রণকক্ষ থেকে বলা হয়, বিভিন্ন জায়গায় পানি জমে বিদ্যুতের তার ছিঁড়ে পড়ছে, আবার আগুন লেগেছে—এমন খবর দিয়ে সাহায্য চাওয়া হচ্ছে।
ঢাকা মহানগর পুলিশের (ডিএমপি) ট্রাফিক বিভাগের অতিরিক্ত কমিশনার মো. মুনিবুর রহমান রাত ১২টার দিকে প্রথম আলোকে বলেন, পানি অপসারণের ব্যবস্থায় সমস্যার কারণে অতিবৃষ্টিতে ঢাকা শহরের বিভিন্ন স্থান পানিতে ডুবে গেছে। এই অবস্থায় সড়কে ধীরগতিতে যানবাহন চলছে। বেশি পানি জমে যাওয়ায় কোনো কোনো স্থানে গাড়ি চলতে পারছে না। বৃষ্টিও চলছে, এ কারণে সড়ক থেকে পানি কমছে না। এসব কারণে রাস্তায় রাস্তায় তীব্র যানজটের সৃষ্টি হয়েছে। যানবাহনে আটকে পড়ে লোকজন। তবুও এসব স্থানে ট্রাফিক পুলিশের সদস্যরা দায়িত্ব পালন করছেন।
ঢাকায় সন্ধ্যা ৬টা থেকে রাত ১২টা পর্যন্ত ১১৩ মিলিমিটার বৃষ্টি হয়েছে বলে আবহাওয়া অধিদপ্তর জানিয়েছে। শুক্রবারও বৃষ্টি হতে পারে। বৃহস্পতিবার সন্ধ্যার পর ঢাকা ছাড়াও সিলেট, রংপুর ও ময়মনসিংহ বিভাগে বৃষ্টি হয়েছে বলে আবহাওয়া দপ্তর জানিয়েছে।
আগামীকালের পূর্বাভাসে অধিদপ্তর জানিয়েছে, রাজশাহী, রংপুর, ময়মনসিংহ ও সিলেট বিভাগের বেশির ভাগ জায়গায় এবং ঢাকা, খুলনা, বরিশাল ও চট্টগ্রাম বিভাগের অনেক জায়গায় অস্থায়ীভাবে দমকা হাওয়াসহ হালকা থেকে মাঝারি ধরনের বৃষ্টি হতে পারে। এ সময় বজ্রপাতও হতে পারে। সেই সঙ্গে রংপুর, রাজশাহী ও ময়মনসিংহ বিভাগের কোথাও কোথাও মাঝারি ধরনের ভারী থেকে ভারী বৃষ্টি হতে পারে।